গাছে থাকাবস্থায় বাগানের ফল বিক্রি করা কি বৈধ?

0
253

আমাদের দেশের মানুষ ফলফলাদি যেমন নিজেরা খাওয়ার জন্য উৎপাদন করে, তেমনি বাণিজ্যিকভাবেও উৎপাদন করে থাকে।

আম, কাঁঠাল, লিচু, পেয়ারা, সুপারি, লটকান ইত্যাদি প্রায় সব ধরনের ফলই বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন করা হয়। এসব ফল কখনও গাছে থাকাবস্থায় বিক্রি করে দেওয়া হয়, আবার কখনও তা পেড়ে বিক্রি করা হয়।

গাছের ফল বিক্রির প্রচলিত পদ্ধতি

গাছের ফল বিক্রির বিভিন্ন পদ্ধতি আমাদের সমাজে চালু আছে। যেমন— ১. বাগান মালিকদের অনেকে অগ্রিম টাকার জন্য কাঁচাফলই গাছে থাকাবস্থায় বিক্রি করে দেন। যাতে অগ্রিম টাকা পেয়ে তারা অন্য কোনো কাজ করতে পারেন। আর পাইকাররাও গাছের কাঁচাফল কিনে রাখেন। এতে তারা ফল পাকার পর বিক্রি করে বেশি মুনাফা অর্জন করতে পারেন।

এ ক্ষেত্রে কিছু বাগান বিক্রি হয় মুকুল বের হওয়ার পর। আর কিছু বাগান বিক্রি হয় ফল মাঝারি আকারের হওয়ার পর।

২. অনেকে একসঙ্গে মোটা অঙ্কের টাকা পাওয়ার উদ্দেশ্যে কয়েক বছরের জন্য বাগানের ফল আগাম বিক্রি করে দেন। বড় বড় অনেক বাগান দুই-তিন বছর কিংবা তার অধিক সময়ের জন্য অগ্রিম বিক্রি হয়ে যায়।

৩. কেউ কেউ গাছে ফল আসার আগেই ফল ব্যবসায়ীদের কাছে খালি বাগান বিক্রি করে দেন।

৪. অনেকে আবার পাইকারদের কাছে এক বা একাধিক বছরের জন্য বাগান ইজারা বা লিজ দেন। বেপারিরা নির্দিষ্ট ভাড়ার বিনিময়ে বাগান ইজারা নিয়ে ফল উৎপাদন করেন।

গাছের ফল বিক্রির শরয়ী বিধান: গাছে থাকা ফল বিক্রির প্রচলিত এসব পদ্ধতির হুকুম এক রকম নয়। এগুলোর মধ্যে কোনোটি বৈধ আবার কোনোটি অবৈধ। নিম্নে প্রত্যেকটির হুকুম পৃথকভাবে উল্লেখ করা হলো—

১ম পদ্ধতির হুকুম: গাছে ফল আসার পর কাঁচা থাকতেই তা বিক্রি করা বিশুদ্ধ মত অনুযায়ী জায়েজ। যদিও ফল তখনও খাওয়ার উপযোগী না হয়। আর ফল পাকা পর্যন্ত বিক্রেতার অনুমতিক্রমে গাছে রেখে দেওয়াও বৈধ। তবে ক্রয়-বিক্রয় চুক্তির সময় ফল পরিপক্ব হওয়া পর্যন্ত গাছে রেখে দেওয়ার শর্ত করলে অনেকে তা নাজায়েজ বলেছেন।

কিন্তু কোথাও এ ধরনের শর্তের প্রচলন হয়ে গেলে গবেষক আলেমদের অনেকে তা জায়েজ বলে ফতোয়া দিয়েছেন। সুতরাং ওই প্রচলনের ভিত্তিতে শর্ত করে গাছে ফল রেখে দেওয়া নাজায়েজ নয়।

অতএব গাছে যখন ছোট ছোট ফল আসবে, তখনই পুরো মৌসুমের ফল বিক্রি করা যাবে। এর পর ক্রেতা সুবিধামতো সময়ে ফল পেড়ে নিতে পারবেন। এভাবে প্রতি বছর গাছে ফল আসার পর তা বিক্রি করতে পারবেন।

২য় পদ্ধতির হুকুম: একত্রে কয়েক বছরের জন্য গাছের ফল অগ্রিম বিক্রি করে দেওয়া জায়েজ নয়। হাদিস শরিফে এ ধরনের ক্রয়-বিক্রয় থেকে স্পষ্টভাবে নিষেধ করা হয়েছে।

হযরত জাবির রাজি. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ‘নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গাছের ফল কয়েক বছরের জন্য অগ্রিম বিক্রি করতে নিষেধ করেছেন।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১৫৩৬)

অতএব প্রচলিত এ ধরনের লেনদেন পরিত্যাগ করা অত্যাবশ্যক।

৩য় পদ্ধতির হুকুম: গাছে ফল আসার আগেই তা অগ্রিম বিক্রি করা জায়েজ নয়। এটি অনুসৃত সব মাজহাব মতেই নাজায়েজ। কারণ গাছে ফল আসার আগে তা বিক্রি করা মূলত বাইয়ে মা‘দুম তথা অস্তিত্বহীন জিনিস বিক্রি করা।

আর হাদিস শরিফে এ ধরনের অস্তিত্বহীন বস্তুর বেচাকেনা থেকে নিষেধ করা হয়েছে। তা ছাড়া এতে ক্রেতার ধোঁকাগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কেননা প্রাকৃতিক নিয়ম অনুসারে কোনো বছর গাছে ফল না আসারও সম্ভাবনা থাকে। আর ফল এলেও কখনও বেশি আসে আবার কখনও কম আসে। আর বিক্রিতব্য পণ্যের মধ্যে এ ধরনের অনিশ্চয়তা থাকলে ক্রয়-বিক্রয় বৈধ হয় না।

হজরত আবু হুরায়রা রাজি. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পাথর নিক্ষেপের মাধ্যমে কেনাবেচা এবং ধোঁকা ও প্রতারণামূলক ক্রয়-বিক্রয় থেকে নিষেধ করেছেন।’
[সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১৫১৩]

অতএব গাছে ফল আসার আগে সমাজে তার ক্রয়-বিক্রয়ের প্রচলন হয়ে গেলেও এমন লেনদেন করা জায়েজ হবে না। (বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন : ফিকহুল বুয়ূ ১/৩২৬-৩৩২)

৪র্থ পদ্ধতির হুকুম: ফল গ্রহণের উদ্দেশ্যে ফলের গাছ বা বাগান ভাড়া দেওয়া ও নেওয়া জায়েজ নয়। সুতরাং বাগান মালিকদের জন্য বাগান ইজারা দেওয়া এবং ব্যবসায়ীদের জন্য তা ইজারা নেওয়া বৈধ হবে না।

বাগানের ফল গ্রহণ করতে চাইলে বিক্রির চুক্তি করতে হবে। অর্থাৎ বাগান মালিকরা বাগানগুলো নিজে পরিচর্যা করবে। অতঃপর যখন গাছে মুকুল আসবে ও ফল ধরবে, তখন তা বিক্রি করে দেবে।

এরপর ক্রেতা সুবিধামত সময়ে ফল পেড়ে নিতে পারবে। এভাবে প্রতি বছর যখন গাছে ফল আসবে তখন নির্দিষ্ট দাম ধরে বিক্রি করতে পারবে। (ফাতাওয়া মাহমূদিয়া ১৬/৫৫৯, ৫৮১; ফাতাওয়া দারুল উলূম যাকারিয়া ৫/১৯৪-১৯৭)

লেখক: মুশরিফ- ফতোয়া বিভাগ, জামেয়া হাকীমুল উম্মত, দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ, ঢাকা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here