বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে এক বিপর্যয়কর চিত্র উঠে এসেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে। খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র প্রকাশ পাওয়ার পর ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় মূলধন সংরক্ষণে হিমশিম খাচ্ছে ব্যাংকগুলো। এর ফলে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর প্রান্তিকে অন্তত ২০টি ব্যাংক মূলধন ঘাটতির মুখে পড়েছে। এসব ব্যাংকের সম্মিলিত মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ লাখ ৭২ হাজার কোটি টাকা, যা এ যাবৎকালের মধ্যে সর্বোচ্চ।
বিশ্লেষকদের মতে, আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে নানা অনিয়ম, লুটপাট ও রাজনৈতিক প্রভাবে বিতরণ করা ঋণগুলোর একটি বড় অংশ দীর্ঘদিন ধরে গোপনে রাখা হলেও রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সম্ভাবনা মাথায় রেখে এখন অনেক ব্যাংক সেগুলোকে খেলাপি হিসেবে স্বীকার করছে। এর ফলে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত যেখানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা, তা এক বছরে বেড়ে ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২ লাখ ১৩১ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ২০.২০ শতাংশ।
এ অবস্থার প্রেক্ষিতে ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে মূলধন সংরক্ষণের চাপ বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু বাস্তবে বহু ব্যাংকই তা সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, তফসিলি ব্যাংকগুলোর ক্যাপিটাল অ্যাডিকোয়েসি রেশিও (CAR) বা মূলধন পর্যাপ্ততা অনুপাত থাকা উচিত ন্যূনতম ১২.৫ শতাংশ। কিন্তু ২০২৪ সালের শেষ প্রান্তিকে এটি কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৩.০৮ শতাংশ, যা ব্যাংক খাতের স্থিতিশীলতার জন্য এক ভয়াবহ সংকেত।
ঘাটতিতে শীর্ষে থাকা ব্যাংকগুলো হল:
-
জনতা ব্যাংক: ৫২,৮৯০ কোটি টাকা
-
কৃষি ব্যাংক: ১৮,১৮৮ কোটি টাকা
-
ইউনিয়ন ব্যাংক: ১৫,৬৮৯ কোটি টাকা
-
ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক: ১৩,৯৯১ কোটি টাকা
-
ইসলামী ব্যাংক: ১২,৮৮৫ কোটি টাকা
-
সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক: ১১,৭০৮ কোটি টাকা
-
আইএফআইসি ব্যাংক: ৯,০০০ কোটি টাকা
-
ন্যাশনাল ব্যাংক: ৭,৭৯৮ কোটি টাকা
এছাড়া বেসিক ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংকসহ আরও কয়েকটি ব্যাংকও হাজার হাজার কোটি টাকার মূলধন ঘাটতির মধ্যে রয়েছে। এমনকি বিদেশি হাবিব ব্যাংকেরও ১২ কোটি টাকা ঘাটতি রয়েছে।
মূলধন ঘাটতি শুধু ব্যাংকের আভ্যন্তরীণ কার্যক্রমেই প্রভাব ফেলছে না, বরং আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং লেনদেন, আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য এবং সাধারণ আমানতকারীদের আস্থায়ও ধাক্কা দিচ্ছে। যেসব ব্যাংকের মূলধনে ঘাটতি রয়েছে, তারা শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ দিতে পারছে না এবং আন্তর্জাতিক লেনদেনেও সীমাবদ্ধতার মুখে পড়ছে।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই সংকট নিরসনে অবিলম্বে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপমুক্ত ও কঠোর নিয়ন্ত্রক পদক্ষেপ প্রয়োজন। খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধার, দায়ীদের বিচারের আওতায় আনা এবং ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় জবাবদিহিতা নিশ্চিত না করা হলে অর্থনীতির এক ভয়াবহ ঝুঁকি অপেক্ষা করছে।