‘সারি সারি মুখ আসে আর যায়/নেশাতুর চোখ টিভি পর্দায়।’ গত শতকের নব্বইয়ের দশকে এই গান গেয়েছিল সংগীত দল মহীনের ঘোড়াগুলি। একুশ শতকের তৃতীয় দশকে নেশাতুর মুখ এখন ঢুলে পড়েছে মোবাইলের পর্দায়।
বাংলাভাষীরা প্রবেশ করেছে তথ্যপ্রযুক্তির ভিন্ন এক দুনিয়ায়; ছবির পর ছবি, মুখের পর মুখ ভেসে ওঠে, ডুবে যায় রঙিন আলোর মায়া-মদির স্রোতে। নতুন এক সমাজব্যবস্থার বাসিন্দা আমরা; রক্তমাংসের উপস্থিতি সেখানে মুখ্য নয়। অথচ সেই উপস্থিতি ছড়িয়ে পড়ে সারা পৃথিবীর সম্ভাব্য সব প্রান্তে। প্রযুক্তিকেন্দ্রিক এই ব্যবস্থাকেই আমরা বলছি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি হাতের মুঠোয় বয়ে নিয়ে বেড়ায় শত শত সমাজ ও সামাজিক সম্পর্ক।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বাংলাকে অনেকে বলেন ফেইসবুকীয় বাংলা; বাংলাভাষীয় জনগোষ্ঠীর কাছে ফেইসবুক অধিকতর জনপ্রিয় বলে এই নামকরণ। যদিও বাঙালিদের ব্যবহার তালিকায় আছে ইন্সটাগ্রাম, টুইটার, লিংকডইনের মতো সাইট। ফেইসবুকের রাজত্বে এক সময় বাংলা লিখতে হতো রোমান হরফে। তখন একে বলা হতো ‘মুরাদ টাকলা’ বাংলা। ‘মুরোদ থাকলে আয়’ এরকম একটি মেসেজে রোমান হরফে লেখা হয়েছিল Murad takla; তারই ভুল পাঠ হিসেবে বাংলায় হয়ে গেছে ‘মুরাদ টাকলা’। এই শব্দযুগল বোঝাত ইংরেজি বর্ণমালা সহযোগে লেখা ভুল বানান, বাক্য ও অর্থগত বিভ্রান্তি যুক্ত বাংলা।
অল্প কিছু দিনের মধ্যেই বাঙালি পেয়েছে বাংলা হরফে লেখার সুযোগ। ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নিজস্ব বাংলা। হাত খুলে লেখার সুযোগ বাঙালি মোটেও ছাড়েনি। বিষয়ের বৈচিত্র্য অনুযায়ী আমরা দেখতে পেলাম বাংলার বিভিন্ন রূপ। ব্যক্তির অঞ্চল, শ্রেণি, ধর্ম, পেশা, লৈঙ্গিক পরিচয়, সামাজিক স্তরবিন্যাস প্রভাব ফেলেছে এই ভাষার ওপর। মানুষ যেমন ব্যক্তিভাষার প্রয়োগ ঘটাচ্ছে, তেমনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তৈরি হওয়া ভাষাকেও সে গ্রহণ করছে। সামগ্রিকভাবে প্রত্যক্ষ সমাজের ভাষা এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ভাষার মিথস্ক্রিয়ামূলক সম্পর্ক নতুন ভাষিক বাস্তবতাকে হাজির করেছে। কী সেই বাস্তবতা?
‘কেউ আমারে মাইরালা’, ‘কুল মাম্মা কুল’, ‘আবার জিগায়’, ‘অফ যা’, ‘মজা লস’, ‘পুরাই টাশকি’, ‘প্যারা নাই’, ‘ফাঁপর লয়’ ‘হেই ব্রো’, ‘খাইতে মুঞ্চায়’ ‘কিয়েক্টাবস্থা’-এ ধরনের প্রচুর বিকৃত শব্দ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ছাড়াও বর্তমান তরুণ প্রজন্মের মুখে মুখে ঘুরছে। আবার টেলিভিশন নাটকের সংলাপেও অনেক উদ্ভট শব্দ শুনতে পাওয়া যায়।
ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যঙ্গ ও উত্ত্যক্ত (ট্রল) করতে কিংবা ইউটিউব বা টিকটকের কিছু বিনোদনধর্মী ভিডিওতে বিকৃত শব্দের পাশাপাশি অশ্লীল ও নোংরা গালাগালির ব্যাপক সমাহার ঘটেছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, এসব কুরুচিপূর্ণ ব্যঙ্গ বা ভিডিওর প্রতি মানুষের আগ্রহ কম নয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এদের জনপ্রিয়তা ঈর্ষণীয়।