কৃষক বাবার সন্তান রাজিব (ছদ্মনাম) পড়েন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) মার্কেটিং বিভাগে। উচ্চ মাধ্যমিক পাসের পর আর্থিক সংকটে তাঁর পড়াশোনার ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তায় পড়ে। পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। টিউশনি করে পড়ালেখা চালিয়ে নেওয়ার আশা ছিল তাঁর। তবে শুরুতেই ধাক্কা খান রাজিব, হলে সিট না মেলায় ওঠেন মেসে।
পরে এক বড় ভাইয়ের সহায়তায় টিউশনি পান রাজিব। এ আয় দিয়ে শিক্ষাজীবন চালিয়ে নিচ্ছেন। দ্রব্যমূল্যের সাম্প্রতিক ঊর্ধ্বগতিতে বিপাকে পড়েছেন। মেসের ভাড়া, খাবার খরচ চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। মাসে অন্তত দেড় হাজার টাকা বাড়তি লাগছে। এর জন্য ধার-দেনা করতে হচ্ছে বন্ধুবান্ধব, চেনা-পরিচিতজনদের কাছ থেকে। ঋণ শোধ না করতে পারছেন না। কয়েক মাসের মেস ভাড়াও পড়েছে বাকি। এতদিন লড়াই করে আসা রাজিবের গলায় এখন হতাশার সুর, ‘সবকিছুর এত দাম! এখন মনে হচ্ছে টাকার অভাবে আমার আর পড়াশোনাই করা হবে না। টিউশনির টাকা দিয়ে আগে চলতে পারতাম। আর সম্ভব হচ্ছে না। মা-বাবাকেও কিছু বলতে পারছি না। তাঁরাই বা টাকা দেবেন কোত্থেকে?’
একই প্রভাব কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সব শিক্ষার্থীর জীবনেই পড়েছে। গণিত বিভাগের ছাত্র ফয়সাল ইসলাম থাকেন শহরের একটি মেসে। তিনি বলেন, ‘কয়েক মাস আগেও ১ হাজার ১০০ টাকা মেস ভাড়া দিয়েছি। এখন সেই ভাড়া দেড় হাজারে ঠেকেছে। অন্যান্য বিল তো আছেই।’
ইংরেজি বিভাগের চতুর্থ বর্ষের এক শিক্ষার্থীও রাজিবের মতো টিউশনি করে খরচ চালান। তাঁর ভাষ্য, বেতন বাড়াতে বলার পর টিউশনি ছেড়ে দিতে বলেছে। যেখানে পড়ান, সেই বাসা থেকে বলা হয়েছে, তাঁদের পক্ষে বেতন বাড়ানো সম্ভব নয়।
ব্যবস্থাপনা শিক্ষা বিভাগের ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের এক ছাত্র জানান, দাম বাড়ার পর থেকে দু’বেলা খাবার খাচ্ছেন। সকালের নাশতা বাদ দিয়েছেন। সকাল-দুপুরের খাবারটা একসঙ্গেই সেরে নিচ্ছেন তিনি।
২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী বর্তমানে অধ্যয়নরত। তাঁদের জন্য হল রয়েছে পাঁচটি। এর মধ্যে ছেলেদের তিনটি ও মেয়েদের দুটি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে ৪৪৮ ছাত্রের থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। বিপরীতে গাদাগাদি করে থাকছেন পাঁচ শতাধিক। কাজী নজরুল ইসলাম হলে ১৬০ জনের জায়গায় প্রায় ২৫০ জন, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত হলে ১৪৪ জনের জায়গায় থাকতে হয় প্রায় ৩০০ ছাত্রকে।
এ ছাড়া নওয়াব ফয়জুন্নেছা চৌধুরানী হলে ১৯৭ জন ছাত্রীর আসন রয়েছে। থাকতে হচ্ছে ২৪২ জনকে। গত ৩১ জুলাই উদ্বোধন করা হয় দ্বিতীয় ছাত্রী হল ‘শেখ হাসিনা হলে’ ২৫৬ জনের আসন থাকলেও এরই মধ্যে ৩৭০ শিক্ষার্থীকে বরাদ্দ দিয়েছে হল প্রশাসন। পাঁচ হল মিলে গাদাগাদি করে থাকতে পারছেন মোট শিক্ষার্থীর সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ। বাকি ৭৫ শতাংশ ক্যাম্পাসের আশপাশের এলাকা অথবা শহরে মেস ভাড়া নিয়ে থাকছেন।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সুযোগ ছাড়েননি মেসমালিকরা। ভাড়াও বাড়িয়ে দিয়েছেন তাঁরা। আগে এলাকা ও বাসাভেদে প্রতি শিক্ষার্থীকে মেস ভাড়া গুনতে হতো ৮০০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা। এখন গুনতে হচ্ছে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ৬০০ টাকা।
মার্কেটিং বিভাগের ছাত্র আবদুল মালেক থাকেন মেসে। তিনি জানান, আগে তাঁর মেসে মিলরেট (প্রতি বেলা খাবারের মূল্য) আসত ৩২ থেকে ৩৫ টাকা। আগস্টে এসেছে ৪৩ টাকা। শুধু খাবারের পেছনেই তাঁর মাসিক খরচ বেড়েছে ৫০০ টাকা।
হলে থাকা শিক্ষার্থীদেরও থাকতে হয় গাদাগাদি করে। হলের ডাইনিং ও কেন্দ্রীয় ক্যাফেটেরিয়ার খাবারে ভর্তুকি নেই। সেখান থেকেও উচ্চমূল্যে খাবার কিনতে হয়।
কাজী নজরুল ইসলাম হলের আবাসিক ছাত্র শরিফুল ইসলামের ভাষ্য, হলের মিলরেটও ৩০ টাকা থেকে বেড়ে ৪০ টাকা হয়েছে। দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে এ খাতে ভর্তুকি থাকলেও কুবি প্রশাসন খাবারে কোনো ভর্তুকি দেয় না।
শায়লা রহমান চৈতী থাকেন নওয়াব ফয়জুন্নেছা চৌধুরানী হলে। তিনি বলেন, ‘দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে সঙ্গে আমার খরচও বেড়েছে। কিন্তু পরিবার থেকে দেওয়া টাকার পরিমাণ তো বাড়েনি। হাত খরচ কমিয়ে মৌলিক ব্যয় বহন করছি।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ক্যাফেটেরিয়ায় অন্তত ১০ জন নিয়মিত গ্রাহকের সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। নৃবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র মুরাদুল ইসলাম বলেন, ক্যাফেটেরিয়াতেও খাবারের দাম বাড়ানো হলেও স্বাদ আগের মতোই বিস্বাদ। এখানে নিয়মিত খেয়ে অরুচিতে ভুগছেন।
ক্যাফেটেরিয়ার পরিচালক মান্নু মজুমদারের দাবি, বাজারে পণ্যের দাম বাড়লেও খাবারের দাম বাড়াননি। আগের দামেই সবকিছু বিক্রি করছেন।
তবে লোকপ্রশাসন বিভাগের ছাত্র তানভীর আহমেদ বলেন, ক্যাফেটেরিয়া দাম না বাড়ালেও পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে। মাছ-মাংসের টুকরোও ছোট করে ফেলা হয়েছে। প্রয়োজনমতো তেল-মসলা না দেওয়ায় খাবারের স্বাদ আগের চেয়েও খারাপ হয়েছে।
একই রকম মন্তব্য করে নৃবিজ্ঞানের ছাত্র কামাল উদ্দিন জানান, আগে দুটি পরোটায় নাশতা সারতেন। এখন চার-পাঁচটা পরোটায়ও ক্ষুধা মেটে না।
বাংলাদেশ ছাত্রলীগ বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি ইলিয়াস হোসেন সবুজ জানান, খাবারে ভর্তুকিসহ শিক্ষার্থীদের দাবি নানা সময় প্রশাসনকে জানিয়েছেন। তাঁরা দাবি না শুনে উল্টো ঊর্ধ্বতন মহলে তাঁর নামে নালিশ করেছে। তবে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির জন্য বৈশ্বিক সংকটকে দায়ী করে বলেন, এখানে তো সরকারের কিছুই করার নেই।
তবে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সদস্য সচিব মোস্তাফিজুর রহমান শুভ বলেন, সরকারের মেগা দুর্নীতির কারণেই নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। যা শিক্ষার্থীসহ জনগণকে ভোগ করতে হচ্ছে।
উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এফ এম আবদুল মঈনকে কার্যালয়ে পাওয়া যায়নি। মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল দেওয়া হলেও মন্তব্য জানা যায়নি। উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) থেকে হলে ভর্তুকির জন্য আলাদা বরাদ্দ দেওয়া হয় না। আবাসন সংকটের বিষয়ে বলেন, ‘আমাদের নতুন ক্যাম্পাসের নির্মাণকাজ চলছে। সেখানে কয়েক গুণ বড় হল নির্মাণ করা হবে। তখন আবাসন সংকট কমে যাবে।’