ভার্চুয়াল জুয়ায় বছরে পাচার হাজার কোটি টাকা

0
100

ভার্চুয়াল জুয়া দিনদিন ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে। এতে ডিজিটাল মাধ্যমে বিদেশে পাচার হচ্ছে বছরে হাজার কোটি টাকা। গুগল-ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দিয়ে কাস্টমার ধরছেন এর কর্ণধাররা।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীরাই তাদের প্রধান টার্গেট। হাতে অ্যান্ড্রয়েড ফোন থাকলেই খেলা যাচ্ছে জুয়া। একযোগে ভার্চুয়াল জুয়ায় মেতে উঠছেন শহর-গ্রামের হাজারো তরুণ-তরুণী। রিকশাচালক থেকে শুরু করে বাদ যাচ্ছে না বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীও।

জুয়ার টাকার জোগান দিতে অন্য অপরাধের পাশাপাশি খুনের ঘটনাও ঘটছে। সর্বশেষ গত ১৩ মার্চ নিজের গাড়িচালকের হাতে খুন হয়েছেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা আফরোজা সুলতানা। ঘাতক হৃদয় বেপারীকে গ্রেফতারের পর গোয়েন্দা পুলিশ জানিয়েছে, সে ভার্চুয়াল জুয়ায় আসক্ত ছিল। জুয়ার টাকার জোগান দিতে স্বর্ণালংকার লুটের উদ্দেশ্যেই সে এ খুনের ঘটনা ঘটায়।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ভার্চুয়াল কারেন্সিতে জুয়া চললেও টাকা লেনদেন হচ্ছে মূলত মোবাইল ব্যাংকিংয়ে। গত কয়েক মাসে ডিবি, সিআইডি, র‌্যাবসহ বিভিন্ন আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা ভার্চুয়াল জুয়ার সঙ্গে জড়িত অর্ধশতাধিক লোককে গ্রেফতার করেছে। তাদের মধ্যে সুপার অ্যাডমিন ও এজেন্টও রয়েছেন।

গোয়েন্দা সূত্রগুলো বলছে, ভারত, রাশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে বসে একটি সংঘবদ্ধ চক্র ভার্চুয়াল জুয়ার সাইট চালাচ্ছে। বিটিআরসি এ পর্যন্ত দুই শতাধিক এ ধরনের সাইট বন্ধ করেছে। কিন্তু এগুলোয় প্রাইভেট নেটওয়ার্ক (ভিপিএন) ব্যবহার করে খেলা চলছে।

সম্প্রতি মোস্টবেট-বিডিডটকম ও ওয়ানএক্সবেটবিডিডটকম নামের বেটিং সাইটের (রাশিয়া থেকে পরিচালিত) সঙ্গে জড়িত এজেন্টসহ ১২ জনকে গ্রেফতার করে সিআইডি। সিআইডি জানতে পারে রাশিয়ায় বসে এই কারবার নিয়ন্ত্রণ করছেন আল আমিন, আশিকুর রহমান ও নাঈম ওরফে হাল্ক নামের তিন বাংলাদেশি যুবক।

গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার একেএম হাফিজ আক্তার যুগান্তরকে বলেন, বিদেশ থেকে ওয়েব হোস্টিং ক্রয়ের কারণে এসব জুয়ার ওয়েব ও অ্যাপ বন্ধের স্থায়ী কোনো উপায় নেই। নজরে আসার পর বিটিআরসির মাধ্যমে ব্লক করালেও ভিন্ন ভিন্ন কৌশলে আবার পরিচালিত হয়। আমরা মনিটরিং বাড়াচ্ছি।

তিনি বলেন, ভার্চুয়াল জুয়ার কারণে পারিবারিক সহিংসতা বেড়ে যাচ্ছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, রিকশাচালক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী পর্যন্ত ভার্চুয়াল জুয়ায় ঝুঁকছে। তিনি বলেন, আইনের কঠোর প্রয়োগের পাশাপাশি সামাজিক আন্দোলন গড়ে না তুললে এ ব্যাধি থেকে মুক্তির কোনো উপায় নেই।

যুগান্তরের অনুসন্ধানে জানা যায়, ভার্চুয়াল জুয়ার কর্ণধার ও এজেন্টরা ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে গ্রুপ ও পেজ খুলে তাদের সাইটে কাস্টমার ধরা এবং কারেন্সি লোড করার বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন। লোভনীয় এসব বিজ্ঞাপনে সাড়াও পাচ্ছেন যথেষ্ট। কারণ বেশির ভাগ বেকার তরুণ-তরুণী অল্প পরিশ্রমে বেশি মুনাফার লোভে এসব জুয়ার সাইটে বিনিয়োগ করেন। খেলতে খেলতে একসময় তাদের নেশায় পরিণত হয়। আর নেশা থেকেই একেকজনের সর্বনাশ ঘটে।

নাইন উইকেটস ডটকম একটি ভার্চুয়াল জুয়ার সাইট। বিদেশে বসে সাইটটি চালানো হচ্ছে। দেশ থেকে লুটে নেওয়া হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। অনুসন্ধানে দেখা যায়, সাইটটিতে একজন অ্যাডমিন, ২০ জন সুপার এজেন্ট এবং ৪৫২ জন অনলাইন এজেন্ট রয়েছেন। এছাড়া লোকাল মাস্টার এজেন্ট এবং লোকাল এজেন্টের সংখ্যা অসংখ্য। সাইটটির কাস্টমার সার্ভিসে কাজ করছেন ৪ জন।

নাম আরমান মালিক, আদনান সামী, ইমরান তরফদার ও আতিফ ইসলাম। তারা ইউজারদের বিভিন্ন সমস্যা ও অভিযোগ নেন। নাইন উইকেটসের অ্যাডমিন আকাশ মালিক নামে পরিচিত। তিনি তার বিস্তারিত পরিচয় দিতে চাননি। তথ্য সংগ্রহের লক্ষ্যে সুপার এজেন্ট হওয়ার আগ্রহ দেখিয়ে আকাশ মালিকের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, তারা আপাতত সুপার এজেন্ট নিচ্ছে না। তবে লোকাল মাস্টার এজেন্ট হওয়ার সুযোগ আছে। একজন সুপার এজেন্টের হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে যোগাযোগ করতে বলেন।

যোগাযোগ করলে ওই সুপার এজেন্ট যুগান্তরকে জানান, লোকাল মাস্টার এজেন্ট হতে হলে ৫০ হাজার টাকার বিনিয়োগ করতে হবে।

আর অনলাইন এজেন্ট হতে জামানত লাগবে ২ লাখ টাকা। এতে সুবিধা কী জানতে চাইলে ওই সুপার এজেন্ট যুগান্তরকে বলেন, তাদের ওয়েবসাইটে অনলাইন এজেন্টের নম্বর দেওয়া থাকবে। সারা বাংলাদেশেই ইউজারদের কাছে পয়েন্ট বিক্রি করতে পারে অনলাইন এজেন্ট। তাছাড়া ইউজার আইডিও খুলে দেন তারা। তাছাড়া ১০০ পয়েন্ট ৯৩ টাকায় কিনে ইউজারের কাছে বিক্রি করতে হবে ১০০ টাকায়। লাভের আরও অনেক সুযোগ আছে।

প্লেবিডি৬৯ ডটকম নামের একটি জুয়ার সাইটের রিভিউ করা হয়েছে ইজি ইনকাম নামের একটি ইউটিউব আইডি থেকে। সাইটটিতে রেজিস্ট্রেশন করে দেখা যায়, এতে ৫ ধরনের খেলা রয়েছে। এর একেকটি খেলায় ১০ টাকা থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত ধরা যাচ্ছে। এই সাইটে ০১৭২২২১৪৯৬৩ নম্বরটি তাদের হেল্পলাইন হিসাবে ব্যবহার হচ্ছে। এখানে ৩০০ থেকে ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত ডিপোজিট করে খেলা যাচ্ছে। এ ধরনের ভার্চুয়াল বেটিং সাইট নয়ালুডু ডটকম, বিডি ফিক্সার প্রভৃতি। এমন অর্ধশতাধিক সাইটের প্রমোশনাল বিজ্ঞাপন দিতে দেখা গেছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। এছাড়া গুগলেও প্রমোশনাল বিজ্ঞাপন দিয়ে চালানো হচ্ছে ভার্চুয়াল বেটিং সাইটের প্রচারণা।

সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি ইমাম হোসেন যুগান্তরকে বলেন, এটি আকাশ সংস্কৃতির একটি অংশ। আকাশের যেমন সীমানা নেই, তেমনই ভার্চুয়াল বেটিংয়েরও কোনো সীমারেখা নেই। তিনি বলেন, যাদেরকে আমরা গ্রেফতার করেছি, তারা নিজেরাও বুঝতে পারে না, তাদের মাধ্যমে দেশের হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, ভার্চুয়াল জুয়া নিয়ন্ত্রণে রাখতে পরিবার থেকে নজরদারি বাড়াতে হবে। সামাজিকভাবে অ্যাওয়ার্নেস বাড়াতে হবে।

সিআইডি বলছে, খেলার জন্য একজন জুয়াড়ি মোবাইল নম্বর বা ইমেইলের মাধ্যমে এই বেটিং সাইটে অ্যাকাউন্ট খুলে। অ্যাকাউন্টের বিপরীতে একটি ই-ওয়ালেট বানিয়ে ব্যালেন্স যোগ করে। এরকম বেশির ভাগ সাইট দেশের বাইরে থেকে পরিচালিত হয়। আর মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে অনলাইন জুয়ার টাকা লেনদেনের তথ্য পেয়েছে সিআইডি।

গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, এসব জুয়ার সাইট দেশের বাইরে থেকে পরিচালিত হলেও দেশের অনেক তরুণ সাবস্ক্রিপশনের মাধ্যমে এজেন্ট হচ্ছে। মূল এজেন্ট ক্লাস্টার আকারে সাব-এজেন্ট তৈরি করছে। সাব-এজেন্ট আবার গুচ্ছ গুচ্ছ আকারে এজেন্ট তৈরি করছে। এতে দিনদিন পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। ভার্চুয়াল কারেন্সিতে পয়েন্টের মাধ্যমে খেলা হলেও এজেন্টরা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা সংগ্রহ করে। আবার কেউ জুয়ায় জিতলে ভার্চুয়াল কারেন্সিকে টাকায় কনভার্ট করে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে ওই জুয়াড়িকে টাকা ট্রান্সফার করে। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, এসব সাইট কিংবা অ্যাপ ব্লক করা হলেও বিভিন্ন উপায়ে আবারও পরিচালনা করা হচ্ছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here