জুলাই-আগস্ট মাসের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় দেশের বিভিন্ন থানা, পুলিশ ফাঁড়ি ও রাজনৈতিক নেতাদের বাড়ি থেকে যে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গুলি লুট হয়, তা এখন দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। পেশাদার অপরাধী, কিশোর গ্যাং, জলদস্যু, মাদক কারবারি এমনকি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের হাতেও পৌঁছে গেছে এসব প্রাণঘাতী অস্ত্র। এর ফলে রাজধানীসহ দেশের নানা স্থানে প্রতিনিয়ত সংঘর্ষ, খুন, গুলিবর্ষণ ও অপরাধমূলক তৎপরতা বেড়েই চলেছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ৫ আগস্টের পর সংঘটিত সহিংসতার সময় ৫ হাজার ৭৫০টি আগ্নেয়াস্ত্র ও ৬ লাখ ১২ হাজার ৯৮৮টি গুলি লুট হয়। এগুলোর মধ্যে রাইফেল, এসএমজি, এলএমজি, পিস্তল, শটগান, গ্যাসগান, টিয়ার গ্যাস লঞ্চার, সাউন্ড গ্রেনেডসহ বিভিন্ন ধরনের উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন অস্ত্র রয়েছে। এপ্রিল পর্যন্ত উদ্ধার হয়েছে মাত্র ৪ হাজার ৩৭২টি অস্ত্র এবং ৩ লাখ ৬৭ হাজার ৭৩২টি গুলি। এখনও উদ্ধার হয়নি ১ হাজার ৩৭৮টি অস্ত্র ও ২ লাখ ৪৫ হাজার ২৫৬টি গুলি।
বিশ্লেষক ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলোর মতে, এই অস্ত্রগুলোর হাতবদল হওয়া এখন একটি সুগঠিত অপরাধ চক্রের অস্তিত্বকেই তুলে ধরছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক বলেন, “যত দিন এই অস্ত্র উদ্ধার না হবে, তত দিন জননিরাপত্তা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে।”
সম্প্রতি লক্ষ্মীপুর, খুলনা, পল্লবী, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ ও কক্সবাজারসহ দেশের নানা প্রান্তে সংঘটিত গোলাগুলি ও হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে লুণ্ঠিত অস্ত্রের সরাসরি যোগসূত্র পাওয়া যাচ্ছে। শুধু ১ এপ্রিলেই লক্ষ্মীপুরে সংঘর্ষের সময় ৬ বছরের শিশু আবিদা গুলিবিদ্ধ হয়। ২ এপ্রিল খুলনায় দুই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর মধ্যে গোলাগুলিতে আহত হয় একাধিক ব্যক্তি। একইভাবে পল্লবী, কামরাঙ্গীরচর, সাতকানিয়া ও গফরগাঁওয়ে সংঘর্ষের ঘটনায় প্রাণহানি ঘটেছে।
পুলিশ জানায়, এই অস্ত্র উদ্ধারে ৪ সেপ্টেম্বর থেকে যৌথ বাহিনীর নেতৃত্বে দেশব্যাপী অভিযান চলছে। তবে এতদিনেও পুরোপুরি উদ্ধার সম্ভব হয়নি। পুলিশের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) ইনামুল হক সাগর বলেন, “৭৬-৭৭ শতাংশ অস্ত্র-গুলি উদ্ধার হয়েছে। জনগণের সহায়তা ছাড়া পুরোপুরি উদ্ধার সম্ভব নয়।”
এই অস্ত্রগুলো অপরাধীদের হাতে যাওয়ায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল হচ্ছে। রাজনৈতিক সংঘর্ষ, মাদক ব্যবসা, টেন্ডারবাজি ও জমি দখলের মতো অপরাধে এই অস্ত্র ব্যবহৃত হচ্ছে ব্যাপকভাবে। সম্প্রতি চট্টগ্রামে ঈদ শুভেচ্ছা ব্যানার টাঙানোকে কেন্দ্র করে বিএনপির দুই গ্রুপের সংঘর্ষ, যেখানে গুলিবিদ্ধ হন অন্তত দুজন—এই ঘটনাও লুণ্ঠিত অস্ত্র ব্যবহারের উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যেই কঠোর নির্দেশনা দিয়েছে এবং জোরালো অভিযান অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই অস্ত্র উদ্ধারে আরও কঠোর অভিযান চালানোর পাশাপাশি জনগণকেও এগিয়ে আসার আহ্বান জানানো হয়েছে।